ইএসআরডি (ESRD) End-Stage Renal Disease হলো কিডনি রোগের সর্বশেষ ধাপ। যখন কিডনি তার ৮৫-৯০% কার্যক্ষমতা হারায় তখন রোগীর জীবন রক্ষায় প্রয়োজনে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন (transplantation) করা হয়।আজকের আলোচনায়, ESRD রোগী ডাইলাইসিস এবং এতদসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
ডায়ালাইসিস কেবল একটি চিকিৎসা পদ্ধতি নয় এটি জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। ডায়ালাইসিস শুরু করার আগে রোগী ও পরিবারের সদস্যদের মনে অনেক প্রশ্ন, ভয় ও বিভ্রান্তি কাজ করতে পারে। যেমন:
১. আমি নিয়মিত চিকিৎসা করেছি, ওষুধ খেয়েছি, ডায়েট মেনেছি—তবুও কেন ডায়ালাইসিস লাগবে?
২. আমি কি বাকি জীবন ডায়ালাইসিসে থাকবো?
৩. এটি কি ব্যথাদায়ক?
৪. আমি কি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবো?
৫. খরচ কত হবে?
৬. কোন পদ্ধতি আমার জন্য ভাল?
এ বিষয়ে আমি বিস্তারিত আলোচনা করব।
ডায়ালাইসিস কী?
ডায়ালাইসিস একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যা কৃত্রিমভাবে শরীর থেকে বর্জ্য ও অতিরিক্ত তরল বের করে। এটি দুইভাবে করা যায়:
১. হেমোডায়ালাইসিস (Hemodialysis)
ক. রক্তকে শরীরের বাইরে এনে একটি বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে পরিষ্কার করা হয়।
খ. সাধারণত সপ্তাহে ২-৩ দিন, একেকবারে ৪ ঘণ্টা লাগে।
গ. প্রয়োজন হয় AV fistula (হাতে একটি বিশেষ রক্তনালী সংযোগ) বা catheter।
২. পারিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস (Peritoneal Dialysis)
ক. পেটের ভেতরে থাকা প্রাকৃতিক পর্দা (peritoneum) ব্যবহার করে তরল বিনিময়ের মাধ্যমে ডায়ালাইসিস হয়।
খ. এটি রোগী নিজে বাসায় করতে পারেন।
গ. প্রতিদিন কয়েকবার তরল ঢোকানো ও বের করার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
ডায়ালাইসিস কেন দরকার হয়?
যখন কিডনি শরীর থেকে পানি, লবণ, ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, ওষুধের বর্জ্য ইত্যাদি অপসারণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন এই বিষাক্ত পদার্থ রক্তে জমে গিয়ে জীবন বিপন্ন করে তুলতে পারে। তখন রোগীর মধ্যে নানা রকম লক্ষণ দেখা দেয় যখন ডায়ালাইসিস ছাড়া আর কোন বিকল্প থাকে না। যেমন:
১. হাত-পা, মুখমণ্ডল বা সারা শরীর ফুলে যাওয়া
২. মাথা ভার লাগা, দুর্বলতা, খাবারে অনীহা
৩. ঘন ঘন বমি বা বমি বমি ভাব।
৪. নিশ্বাসে কষ্ট, বুকে চাপ।
৫. প্রস্রাব কমে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়া
৬. মানসিক বিভ্রান্তি, খিঁচুনি
৭. রক্তে পটাশিয়াম বেড়ে হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়া (life-threatening arrhythmia)
কোন পদ্ধতি আপনার জন্য উপযুক্ত?
এটা রোগীর বয়স, আনুষ্ণঙ্গিক অন্যান্য রোগ, শারীরিক অবস্থা, জীবনযাপন পদ্ধতি, কাজের/পেশার ধরন ও পারিবারিক সহায়তার উপর নির্ভর করে। চিকিৎসকের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
| বিষয় | হেমো-ডায়ালাইসিস | পেরিটোনিয়াল-ডায়ালাইসিস |
| স্থান | হাসপাতালে | বাসায় |
| সময় | সপ্তাহে ২-৩ বার | প্রতিদিন ৩-৪ বার |
| চলাফেরা | ডায়ালাইসিস দিনে সীমিত | তুলনামূলকভাবে স্বাধীনতা বেশি |
| হাস্পাতাল হতে দূরত্ব | বাড়ি থেকে হাস্পাতাল দূরে হলে অসুবিধা জনক | বাড়ি থেকে হাস্পাতাল দূরে হলে কোন সমস্যা নেই |
| অন্যান্য রোগ | হার্ট ফেইলিওর থাকলে এ ধরনের ডাইলাইসিস করা ঝুকিপুর্ণ | পেটে পূর্বে কোন অপারেশন থাকলে এ ধরনের ডাইলাইসিস করা যায় না |
জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনঃ ডায়ালাইসিস শুরু হওয়ার সাথে বিভিন্ন ধরনের খাবারের প্রতি যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা উঠিয়ে নেয়া হয়। তবে পাশাপাশি আপনাকে নিচের কিছু নিয়ম মানতে হবে:
১. প্রোটিন: পরিমাণমতো (১.২-১.৪ গ্রাম/কেজি শরীরের ওজন হিসাবে প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে (আপনার নেফ্রোলজিস্ট গাইড করবেন).
২. সোডিয়াম/লবণ: কম খেতে হবে
৩. পটাশিয়াম: কলা, আলু, টমেটো—কম খেতে হবে.
৪. ফসফরাস: ডাল, বাদাম, দুধ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত
৫. পানি: নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি নয়.
৬. ঔষধ: নিয়মিত ফসফেট বাইন্ডার, আয়রন, ভিটামিন ডি ইত্যাদি খেতে হব
ডায়ালাইসিস প্রস্তুতি
ডায়ালাইসিস মানে জীবন শেষ নয়। হাজারো মানুষ সফলভাবে ডায়ালাইসিস করে সংসার, চাকরি, শিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে।
১. মানসিক প্রস্তুতি
শুরুতে আতঙ্ক, হতাশা, অনিশ্চয়তা, লজ্জা বা রাগ আসতে পারে—এটি স্বাভাবিক।আত্মবিশ্বাস গড়তে হবে: মনে রাখবেন, ডায়ালাইসিস আপনাকে সুস্থ রাখে, দুর্বল করে না।হতাশা মোকাবিলায় কনসেলিং নিতে পারেন—সামাজিক কর্মী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অথবা অন্য ডায়ালাইসিস রোগীর অভিজ্ঞতা শুনতে পারেন নিজেকে মূল্য দিন—আপনার জীবনের মূল্য আছে, এবং ডায়ালাইসিস সেই জীবনকে দীর্ঘ করে।
২. শারীরিক প্রস্তুতি
ফিস্টুলা [Fistula] তৈরি করতে হতে পারে—এটি অস্ত্রোপচার হলেও সাধারণত ছোট ও নিরাপদ। শরীরে পানির ভারসাম্য, পটাশিয়াম, হিমোগ্লোবিন ঠিক রাখতে ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে। শুরুতে কিছু দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, বমি হতে পারে—তা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়। শরীরচর্চা, হালকা ব্যায়াম ও পরিমিত ঘুম শরীর সুস্থ রাখতে সহায়তা করে।
৩. পারিবারিক প্রস্তুতি
পরিবারের সদস্যদের বিষয়টি বুঝতে হবে—এটি রোগীর একার লড়াই নয়। চিকিৎসা শিডিউল, হাসপাতালে যাতায়াত, খাবার তৈরি, মানসিক সমর্থনে পরিবারের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। যদি রোগী পারিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস বেছে নেন, তবে পরিবারকে শেখানো হয় কিভাবে বাসায় সহায়তা করবেন। পরিবারের কারো কাছ থেকে অঙ্গদানের ভাবনা থাকলে তা সময়মতো পরিকল্পনায় আসতে পারে।
৪. অর্থনৈতিক প্রস্তুতি
ডায়ালাইসিস একটি চলমান চিকিৎসা—প্রতি সপ্তাহে ২-৩ বার দীর্ঘ মেয়াদে চলবে। সরকারি হাসপাতালে তুলনামূলক কম খরচে সেবা পাওয়া যায়। কিছু NGO বা সমাজকল্যাণ বিভাগ আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে (যেমনঃ ব্র্যাক, Kidney Foundation) ওষুধ, ডায়েট, যাতায়াত খরচ হিসাব করে মাসিক বাজেট পরিকল্পনা করুন।
শেষ কথা
আপনার কিডনি হয়ত বিশ্রাম চায়—কিন্তু জীবন থেমে যেতে চায় না। ডায়ালাইসিস হলো সেই জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার পথ। সঠিক সিদ্ধান্ত, নিয়মিত চিকিৎসা, পারিবারিক সহায়তা ও মানসিক শক্তি থাকলে আপনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। ডাইলাইসিস শুরুর আগে যে দীর্ঘ চিকিৎসা আপনি নিয়েছেন তা এই ডাইলাইসিস কে বিলম্বিত করার জন্য। স্মরণে রাখুন: “ডায়ালাইসিস আপনার জীবন বাঁচাতে পারে, জীবন কেড়ে নেয় না।”
লেখক
অধ্যাপক ডা. মো. মাকসুদুর রসুল
মেডিসিন ও কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ
চেম্বার: আলোক হাসপাতাল, মিরপুর-৬
হটলাইন: ১০৬৭২
Website: https://aalokhospitalbd.com

