ডাউন সিনড্রোম একটি জেনেটিক রোগ যা মানবদেহে ক্রোমোজোমের বিশেষ ত্রুটির জন্য হয়ে থাকে। সাধারণত একটি শিশু ৪৬ টি (২৩ জোড়া) ক্রোমোজোম নিয়ে জন্মায়। ২১ তম জোড়া ক্রোমোজোমের সাথে অতিরিক্ত ক্রোমোজোম (৩য় কপি) উপস্থিত থাকলে ক্রোমোজোমের সংখ্যা দাড়ায় ৪৭ টি, এই জেনেটিক অসমতাই ট্রাইজোমি ২১ বা ডাউন সিনড্রোম।
ক্রোমোজোমাল ত্রুটিজনিত রোগের মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। বিশ্বে প্রতি ৭০০ জন শিশুর মধ্যে জন্ম নেয় একটি ডাউন সিনড্রোম শিশু। স্বতন্ত্র শারীরিক গঠন, শিশু বিকাশে বিলম্ব এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতা এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
বিশ্বে ডাউন সিনড্রোম দিবসঃ
প্রতিবছর ২১ মার্চ দিবসটি পালিত হয়। এই দিনটিতে ডাউন সিনড্রোম শিশুদের অধিকার ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং তাদের দক্ষতা, সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই সকল শিশু অন্য সকলের মতন ন্যায্য অধিকার ও উন্নত জীবনের দাবীদার।
কারণঃ
চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই অবস্থার কোন সুনির্দিষ্ট কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।
কাদের ঝুঁকি বেশি—
- বেশি বয়সে মা হয়েছেন (>৩৫ বছর) এমন মহিলাদের সন্তানদের মধ্যে এর ঝুঁকি বেশি বলে মনে করা হয়
- যেসব বাবা মায়ের ইতিমধ্যে এমন সন্তান রয়েছে তাদের পরবর্তী সন্তানদের ক্ষেত্রেও এ জেনেটিক ঝুঁকি থেকে যায়
লক্ষণ ও জটিলতাঃ
এদের দেখতে প্রায়ই একই রকমের মনে হয়ে থাকে, আচরণ মিল থাকতে পারে, তবে প্রত্যেকে আলাদা কিছু বৈশিষ্ট থাকে। ডাউন সিনড্রোম শিশুদের কিছু স্বতন্ত্র শারীরিক বৈশিষ্ট্য থাকে যেমন ছোট মাথা, চ্যাপ্টা মুখ, ছোট নাক, চোখের কোণ উপরের দিকে উঠানো, প্রসারিত জিহবা, অস্বাভাবিক ছোট কান, ছোট গলা, হাতের তালুতে একটি মাত্র রেখা এবং অপেক্ষাকৃত ছোট আঙুল, ছোট হাত এবং পা। এদের শরীরে মাংসপেশী দুর্বল হয় বলে শিশুগুলো খুব নরম তুলতুল হয়। কম উচ্চতা, কানে কম শুনা, কথা বলতে দেরি, শিশু বিকাশ বাধাগ্রস্থ হওয়া ইত্যাদি জটিলতা থাকে। কিছু ক্ষেত্রে হার্টে জন্মগত ত্রুটি থাকে।
নানাবিধ আন্ত্রিক সমস্যা, রক্তরোগ, খিঁচুনি, বিলম্বিত বয়ঃসন্ধি, থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা এবং কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, শরীর স্থুল হতে পারে। পাশাপাশি তাদের আই—কিউ (বুদ্ধিমত্তা) সাধারণত গড় মানের নীচে থাকে এরফলে স্বাভাবিক শিক্ষার ধারা ধীর গতির হয়ে থাকে। কিছু শিশুকে স্বাভাবিক বিদ্যালয় শ্রেণী কক্ষে শিক্ষা দেয়া হলেও কিছু ক্ষেত্রে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান শিক্ষা দিতে হয়। কেউ কেউ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে উচ্চ মাধ্যমিক এবং এর উপরেও পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারে।
পছন্দঃ
এই সকল শিশু মিশুক প্রকৃতির, খুব নাচতে পছন্দ করে, সাথে গাইতে, গান শুনতে এবং ছবি আঁকতে পছন্দ করে। এদের মধ্যে খাবার অনীহা দেখা যায়। কেউ কেউ প্রচন্ড খেতে পছন্দ করে। একাডেমিক পড়াশোনার চাইতে ভিন্ন কিছু তাদের পছন্দ।
শনাক্তকরণঃ
প্রাথমিকভাবে শিশুর মুখের চেহারার পর্যবেক্ষন করে এই রোগ সনাক্ত করা হয়। তারপর ক্রোমোজোম বিশ্লেষণের জন্য ক্যারিয়োটাইপিং নামক রক্ত পরীক্ষা দ্বারা ডাউন সিনড্রোম ক্রোমোজম—২১ এর অতিরিক্ত অনুলিপি নিশ্চিত করা হয়।
তাছাড়া গর্ভবস্থায় ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুর জন্মের ঝুঁকি সনাক্ত করতে কিছু স্ক্রিনিং পরীক্ষা ব্যবহার করা হয় যা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারে। গর্ভাবস্থায় ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত হল গর্ভপাতের পরামর্শ দেয়া হয়।
চিকিৎসা—
ডাউন সিনড্রোমের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই তবে বিভিন্ন ধরনের সহায়ক চিকিৎসা (থেরাপি)-খুবই গুরুত্বপূর্ণ।এই শিশুরা কয়েক ধরণের শারীরিক সমস্যা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে থাকে। তাই জন্মের পর থেকেই নিবিড় যত্নের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন। মোটকথা যত্ন যত বেশী প্রারম্ভিকভাবে শুরু করা যাবে তত দ্রুত শিশু স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করতে পারবে। এক্ষেত্রে বাবা-মার/ কাউন্সিলিং অত্যন্ত জরুরী, তাদের সচেতন করা অত্যন্ত জরুরী। ফিজিওথেরাপি, স্পিচ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি এবং জটিলতা ভিত্তিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে অবস্থাটিকে সামলানো যায়।
বিশেষায়িত স্কুল, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, বিশেষ খেলাধুলা সহ একটি সহায়ক পরিবেশ এই শিশুদের মানসিক অবস্থায় উন্নয়ন ঘটায় এবং তাদের সম্ভাবনাগুলোকে সর্বোচ্চ মাত্রায় পূর্ণ করতে সাহায্য করে।
করণীয়ঃ
একটি ডাউন সিনড্রোম শিশুর জীবন একটি বিশেষ চ্যালেঞ্জ হলেও তাদের অভিভাবকদের কাউন্সেলিং, সঠিক যত্ন, সামাজিক সহযোগিতা, বিশেষায়িত শিক্ষার মাধ্যমে তাদের আস্থার পরিবর্তন সম্ভব। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। এই রোগের প্রতিকার নেই, তাই ডাউন সিনড্রোম শিশুদের পরিবারে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করে নিয়মিত থেরাপি ও চিকিৎসা নিশ্চিত করলে তাদের জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা সম্ভব।
লেখক
ডাঃ ইমনুল ইসলাম ইমন
অধ্যাপক, শিশু বিভাগ
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
চেম্বার: আলোক মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার, মিরপুর -৬ ঢাকা।
হটলাইন : ১০৬৭২
Website: https://aalokhospitalbd.com

