pregnancy

গর্ভাবস্থা একজন নারীর জীবনের একটি বিশেষ ও সংবেদনশীল সময়। এ সময় শুধু শারীরিক পরিবর্তনই ঘটে না; মানসিক ও আবেগজনিত নানা পরিবর্তনেরও সম্মুখীন হতে হয়। গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং প্রসব-পরবর্তী সময়ে প্রতিটি নারীই কম-বেশি মানসিক চাপে ও দুশ্চিন্তায় থাকেন। মায়ের শারিরীক ও মানসিক সুসাস্থ্য সাথে অনাগত সন্তানের মানসিক বিকাশ ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত। যদিও এই বিষয়টি যতটা গুরুত্বের দাবিদার অধিকাংশ যেত্রে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী পায় ১০%-১৩% নারী গর্ভাবস্থায় বা প্রসব পরবর্তী সময়ে মানসিক সমস্যায় ভোগেন। উন্নয়নশীল দেশে এই হার- গর্ভাবস্থায় ১৫.৫%; প্রসব পরবর্তীতে ১৯.৮%। বাংলাদেশে গ্রামীন গর্ভবতী নারীদের ধারণামতো ৩৩-৫৬%, ডিপ্রেশনে/ বিষণ্নতায় ভোগেন এবং ২৯% উদ্বেগে ভুগছেন।

গর্ভাবস্থা ও প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতার মূল

কারণসমূহঃ-

  • শরীরে হরমোন যেমন ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের হঠাৎ ওঠানামা বা তারতম্য
  • স্বামী ও শ্বশুরবাড়ি বা নিজের পরিবারের সহানুভূতি ও সহাযোগিতার অভাব
  • একাকীত্ব ও ভালোবাসার অভাব ও একটি বড় কারন।
  • গর্ভকালীন চিকিৎসা ও শিশুর যত্ন নেয়ার আর্থিক সংগতিক অভাব।
  • অনাকাঙ্খিত গর্ভাবস্থা, বাল্য বিবাহ
  • ইন্টিমেট পার্টনার ভায়োলেন্স (IPV)/স্বামীর দ্বারা শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন একটি বড় কারণ।
  • দাম্পত্য কলহ
  • গর্ভাবস্থায় জটিলতাঃ- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড সমস্যা ইত্যাদি, প্রসবকালীন জটিলতা, সিজার করার পর ব্যথা, দুর্বলতা, ঘুমহীনতা ও উদ্বেগ, খিচুনি (একলাম্পশিয়া), নবজাতচকের মৃত্যু, প্রসত জনিত ফিস্টুলা ইত্যাদি
  • আত্মবিশ্বাসের অভাব ও অপরাধবোধ, অতিরিক্ত কাজ নতুন মায়েদের বেশি হয়
  • পূর্বের মানসিক রোগের ইতিহাস, পারিবারিক ইতিহাস
  • সামাজিক স্টিগমা বা কথা শুনতে হয়~

– ছেলে না হওয়া, মৃত শিশু হওয়

    – শিশুকে দুধ ঠিকমতো না খাওয়াতে পারা

  • পূর্ববর্তী বন্ধ্যাত্ব, গর্ভপাত, বা জন্মগত ত্রুটিযুক্ত শিশুর ইতিহাস

প্রভাবঃ মায়ের উপর

  • প্রসব পরবর্তী মানসিক সমস্যা দীর্ঘায়িত হতে পারে
  • বারবার মানসিক সমস্যাগুলো হওয়া
  • আত্মহত্যা জনিত প্রবণতা, আত্মহত্য ঘটানো
  • নবজাতক হত্যা

বাবার উপর ! বিষন্নতায় আক্রান্ত হতে পারেন।

গর্ভাস্থ শিশুর উপর

  • পুষ্টি ও বৃদ্ধি ব্যাহত হয়- ফলে কম ওজনের শিশু জন্ম নিতে পারে।
  • অকাল প্রসব হতে পারে।

সন্তানের/ শিশুর উপর।

  • আবেগজনিত ও আচরণগত মানসিক রোগ দেখা দেয়া,
  • অতিরিক্ত কান্না, খাবার ও ঘুমের সমস্যা।
  • স্বাভাবিক বিকাশ ব্যহত হওয়া।

প্রসবোত্তর মানসিক সমস্যা কখন এবং কেমন হয়?

ম্যাটারনিটি ব্লু/ Port Partum Blue: প্রায় দুই তৃতীয়াংশ প্রসূতি মা Blue তে আক্রান্ত হন। খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তি, দুঃখবোধ, দ্রুত মুড পরিবর্তন, মনোযোগ কমে যাওয়া, ঘুম ও-খাবারের সমস্যা ইত্যাদি দেখা যায়। প্রসবের ৩-৪ দিনের মধ্যে লক্ষণগুলো সবচেয়ে বেশি মাত্রায় পৌছে এবং সর্বোচ্চ ২-সপ্তাহের মধ্যে ধীরে ধীরে চলে যায়। সাধারণত কোন চিকিৎসার দরকার হয় না। সুষম খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম এবং সর্বোপরি মাকে মানসিক সমর্থন দিয়েই এ সমস্যার সমাধান করা যায়।

প্রসব পরবর্তী বিষন্নতা/Post Portum Depression: গবেষনায় দেখা গিয়েছে প্রায় ৫% মায়েদের গুরুতর বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে। এই বিষণ্নতার লক্ষণগুলো তীব্র ও দীর্ঘ মেয়াদি হয়। সাধারণত প্রসবের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শুরু হয়। লাক্ষণগুলোর মধ্যে- মুডসুইং, অতিরিক্ত কান্না, শিশুর সাথে বন্ধন তৈরীতে অনিহা, নিজেকে একা লাগা, বা গ্লানিতে ভোগা, খাবারে অরুচি, বাচ্চার ক্ষতিকরার চিন্তা, আত্মহত্যার চিন্তা ইত্যাদি। তবে সবার মধ্যে সব লক্ষণ থাকবে তা নয়। এক্ষেত্রে মনোরোগ, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হয়।

প্রসবোত্তর সাইকোসিস (Post Partuem Psychosis).

প্রতি ১০০০ প্রসবে ১-২ জনের হয়, প্রসবের ২/৩ দিন থেকে ২/১ সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণ দেখা দেয় এবং খুব দ্রুত অবস্থার অবনতি ঘটে। বিভ্রান্তি, সন্দেহ প্রবনতা, শিশুর বিষয়ে অবসেশন, হ্যালুসিনেশন, ডিলিউশান, নিজের অথবা বাচ্চার ক্ষতিকরা এমনকি মেরে ফেলার মত কাজ করা। তবে আশার কথা হচ্ছে সময়মত চিকিৎসা শুরু হলে ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই মা সুস্থ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে অব্যশই মনোরোগ ও গাইনী অবস বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।

করনীয়:

  • গর্ভধারনের পরিকল্পনা করার সময় থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। এসময়ে হবু মা, স্বামী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের গর্ভধারণ ও যত্ন সম্পর্কে মানসিকভাবে প্রস্তত করা হয়। গর্ভবতী নারীর, গৃহ ও কর্মস্থল –সবক্ষেত্রেই নিরাপদ পরিবেশ প্রদান করা উচিত।
  •  প্রসব পরবর্তী সময়ে সবাই এবং মা নিজেও নবজাতক কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেন। এতে করে মায়ের যত্ন- বিশ্রাম ব্যহত হয়। তাই স্বামীসহ পরিবারের সকল সদস্যদের সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে।
  • পূর্ব থেকে মানসিক সমস্যার সনাক্ত মা অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও গাইনী অবস চিকিৎসকের  পর্যাবেক্ষেনে ও পরামর্শ থাকবেন। গর্ভস্থ বাচ্চার জন্য নিরাপদ ঔষধ সেবন এবং এর পরিমাণ নির্ধারণ/ পরিবর্তনের জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
  • শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, মা যদি গুরুতর বিষন্নতায় ভোগেন, তবে শিশুকে বুকের দুধ পান করা সহ সার্বক্ষনিক দায়িত্বশীল অন্য কারো পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। কারো কারো ক্ষেত্রে বুকের দুধ না দেয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়।
  • শুধু শারীরিক নয়, মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। স্বাস্থ্য কর্মীদের মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান আবশ্যক।

সুস্থ্য মা-সুস্থ্য শিশু।

তাই আসুন আমরা গর্ভবতী মায়ের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে যত্নে সমানভাবে সচেতন হই।

লেখক

ডাঃ সারাবান তহুরা

এমবিবিএস, ডিজিও, এফসিপিএস, ডিএমইউ

কনসালটেন্ট, গাইনি এন্ড অবস

চেম্বার : আলোক মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার, মিরপুর-৬

হটলাইন: ১০৬৭২

Website: https://aalokhospitalbd.com

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *