ডায়াবেটিস একটি বিপাকজনিত রোগ । বর্তমান সময়ে পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষের গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম ।

ডায়াবেটিস শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ থেকে যার অর্থ হচ্ছে Siphon এবং মেলাইটাস শব্দটা এসেছে ল্যাটিন শব্দ থেকে যার অর্থ মধু I অর্থাৎ ডায়াবেটিস রোগের প্রধান লক্ষণ হলো প্রচুর পরিমাণ মিষ্টি স্বাদযুক্ত প্রস্রাব করা। তাই প্রাচীন ভারতে হাজার হাজার বছর ধরে রোগটি মধুমেহ নামেও পরিচিত ছিল।

আমাদের দেহ কোষ সমূহ রক্ত থেকে গ্লুকোজ গ্রহন করে শক্তি উৎপাদন করে। কোষের এই গ্লুকোজ গ্রহনের জন্য ইনসুলিন নামক হরমোনের প্রয়োজন।

কোন কারনে আমাদের শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন কমে গেলে অথবা ইনসুলিনের কার্যকারিতা হ্রাস পেলে কোষে গ্লুকোজ প্রবেশ করতে পারে না এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়তে থাকে । এই সামগ্রিক অবস্থাই হচ্ছে ডায়াবেটিস মেলাইটাস I 

  কাদের ডায়াবেটিস বেশী হয়

* যাদের বংশে (মা-বাবা , ভাই-বোন, ছেলে মেয়ে, মামা খালা, দাদা-দাদী ও নানা নানী) ডায়াবেটিস আছে ।

* যাদের ওজন বেশী I

* যারা ব্যায়াম অথবা শারীরিক পরিশ্রম করেন না।

* যারা দীর্ঘদিন স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ সেবন করছেন ।

* এছাড়া বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে

* যে সমস্ত মহিলার গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে

* যে সমস্ত মহিলার পলিসিস্টিক ওভারী সিন্ড্রোম (Pcos) আছে

ডায়াবেটিস রোগের জন্য বংশ গত ও পরিবেশগত দুটো কারনই দায়ী । তবে ডায়াবেটিস কোন সংক্রামক  বা ছোঁয়াছে রোগ না ।

ডায়াবেটিস রোগের লক্ষণ কী

* ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া

* খুব বেশী পিপাসা লাগা বা গলা শুকিয়ে আসা

* বেশী ক্ষুধা পাওয়া এবং প্রচুর পরিমাণে খাওয়া সত্বেও ওজন কমে যাওয়া

* অত্যধিক ক্লান্তি বোধ করা

* চোখে কম দেখা

* ক্ষত শুকাতে বিলম্ব হওয়া

* বিভিন্ন চর্মরোগ যেমন খোস – পাঁচড়া, ফোঁড়া বেশী হওয়া

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যা প্রয়োজনঃ

* রোগী ও পরিবারের সদস্যদের ডায়াবেটিস সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা ।

* খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, নিয়মিত ব্যায়াম ও শৃংখলাবোধ।

* প্রয়োজনে মুখে খাবার ঔষধ অথবা ইনসুলিন l

গবেষণায় দেখা গেছে, জীবনধারা পরিবর্তন , নিয়মিত মধ্যম মাত্রায় ব্যায়াম ও পরিমিত ওজন হ্রাস ২৫ – ৬০% পর্যন্ত ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায় এবং প্রি ডায়াবেটিক থেকে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য পরিমান কমায়। তাই ডায়াবেটিস একটি সারা জীবনের রোগ হলেও সঠিক খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত ব্যায়াম ও আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ডায়াবেটিস ভাল ভাবে নিয়ন্ত্রণ রেখে প্রায় স্বাভাবিক কর্মঠ জীবন যাপন করা সম্ভব।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখলে যে সমস্ত জটিলতা দেখা দিতে পারেঃ

* হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, পক্ষাঘাত, নার্ভের সমস্যা (নিউরোপ্যাথি ), কিডনি সমস্যা (নেফ্রোপ্যাথি ), চোখের সমস্যা যেমন- চোখের মধ্যে রক্তক্ষরণ’ এবং অন্ধত্ব, পায়ে পচনশীল ক্ষত, পাতলা পায়খানা, মাড়ির প্রদাহ, খোঁস পাচড়া ইত্যাদি অসংখ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে ।

* এছাড়া অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারনে পুরুষের যৌন ক্ষমতা হ্রাস, মহিলাদের বেশী ওজনের শিশু জন্মদান, মৃত শিশু প্রসব,জন্মের পরই শিশুর মৃত্যু এবং নানা ধরনের জন্মগত ত্রুটি নিয়ে শিশুর জন্ম হতে পারে ।

* তবে ডায়াবেটিস সুনিয়ন্ত্রিত থাকলে এই সমস্ত মারাত্মক জটিলতা থেকে অনেকাংশে মুক্ত থাকা যায়।

ডায়াবেটিস রোগীর পায়ের যত্নঃ 

পায়ের বিশেষ যত্ন নিতে হবে ,অন্যথায় আঘাত লেগে পঁচনশীল ঘা দেখা দিতে পারে I যা চিকিৎসা করা কঠিন এমনকি পা কেটে ফেলতে হতে পারে ।

পায়ের যত্নে যা করতে হবে-

* খালি পায়ে হাঁটা যাবে 

* নরম ও আরামদায়ক জুতা পরতে হবে।

* মোজা ছাড়া জুতা পরবেন না , তবে ভিজে  মোজা পড়া নিষেধ I

* পায়ের নখ কাটতে নেইল কাটার ব্যবহার করবেন তবে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যেন আঙ্গুলে আঘাত না লাগে ।

* পায়ের কড়া নিজে কাটবেন না ।

* প্রতিদিন কুসুম গরম পানি ও সাবান দিয়ে ভালো ভাবে পা ধূতে হবে এবং শুকনা কাপড় দিয়ে পা  ও দুই আঙ্গুলের মাঝের জায়গা ভালভাবে মুছে ফেলতে হবে

* স্বাভাবিক রক্ত চলাচলের জন্য প্রতিদিন পায়ের ব্যায়াম করতে হবে।

ডায়াবেটিস রোগীর  দাঁত ও মাড়ির যত্ন

* সকালে নাস্তার পর ও রাতে ঘুমানোর আগে অবশ্যই দাঁত ব্রাশ করতে হবে

* দাঁত ব্রাশ করার পর এক মিনিট আঙ্গুলের সাহায্যে মাড়ি মালিশ করলে রক্ত চলাচল বাড়ে ও মাড়ি শক্ত এবং মজবুত হবে।

* পান, সুপারি, জর্দা, চুন খাওয়া এবং ধূমপান মাড়ির রোগ ত্বরান্বিত করে তাই এই সব অভ্যাস অবশ্যই বাদ দিতে হবে ।

*এছাড়া প্রত্যেক ডায়াবেটিক রোগীকে ডায়াবেটিসের  জরুরী অবস্থা বিশেষ করে রক্তের সুগার কমে যাওয়া বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে এবং এর লক্ষন সমূহ ও তাৎক্ষনিক চিকিৎসা সম্পর্কে অবশ্যই জ্ঞান থাকতে হবে । 

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাসায় গ্লুকোমিটার দিয়ে নিজের রক্তের গ্লুকোজ পরিমাপ করা এবং রক্তের সুগার দেখে চিকিৎসা মনিটরিং করা I     এতে রক্তের সুগার আরো সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব I তাই নিজে নিজের glucose  পরিমান অর্থাৎ SMBG( Self Monitoring of blood glucose) ডায়াবেটিস চিকিৎসা ও নিমন্ত্রনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ I     

লেখক                 

ডাঃ অনন্ত কুমার কুন্ডু

ডায়াবেটিস ও হরমোন জনিত রোগ ও   পুষ্টি বিশেষজ্ঞ।

বারডেম জেনারেল হাসপাতাল ,শাহবাগ ঢাকা ।

চেম্বারঃ আলোক হেলথ কেয়ার ,মিরপুর-১০

হটলাইন: ১০৬৭২

Website: https://aalokhealthcare.com

dr ananta kundu

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *